সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

দ্বীনে ইসলামীর সৌন্দর্য

 


একগুচ্ছ মুক্তাদানা

সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর জন্য; আমরা তাঁর প্রশংসা করি, তাঁর নিকট সাহায্য ও ক্ষমা প্রার্থনা করি; তাঁর নিকট তাওবা করি; আর আমাদের নফসের সকল খারাপি এবং আমাদের সকল প্রকার মন্দ আমল থেকে আল্লাহর নিকট আশ্রয় চাইআল্লাহ যাকে পথ প্রদর্শন করেন, তাকে পথভ্রষ্ট করার কেউ নেই; আর যাকে তিনি পথহারা করেন, তাকে পথ প্রদর্শনকারীও কেউ নেইআর আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, একমাত্র আল্লাহ ছাড়া কোন সত্য ইলাহ নেই, তাঁর কোন শরীক নেই এবং আমি আরও সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর বান্দা ও রাসূল; তাঁর প্রতি অনেক সালাত (দরূদ) ও সালাম।

অতঃপর:

নিশ্চয় মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আনিত দ্বীনে ইসলাম সকল ধর্ম ও জীবনব্যবস্থার চেয়ে পরিপূর্ণ, সর্বোত্তম ও সর্বমহান দ্বীন ও জীবনব্যবস্থা। আর এই দ্বীনটি এমন সার্বিক সৌন্দর্য, পরিপূর্ণতা, যথার্থতা, সম্প্রীতি, ন্যায়পরায়ণতা ও প্রজ্ঞাকে অন্তর্ভুক্ত করেছে, যা আল্লাহ তা‘আলার জন্য সার্বিক পরিপূর্ণতা এবং জ্ঞান ও প্রজ্ঞার ব্যাপকতার সাক্ষ্য বহন করে; আর তাঁর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জন্য এই সাক্ষ্য বহন করে যে, তিনি সত্যিকারভাবে আল্লাহর রাসূল এবং তিনি সত্যবাদী ও বিশ্বস্ত; যিনি মনগড়া কোন কথা বলেন না:﴿إِنۡ هُوَ إِلَّا وَحۡيٞ يُوحَىٰ ٤﴾ [النجم:4] “তা তো কেবল ওহী, যা তার প্রতি ওহীরূপে প্রেরিত হয়।” [সূরা আন-নাজম, আয়াত: ৪]

সুতরাং এই ইসলামী দ্বীন আল্লাহ তা‘আলার জন্য তাঁর একত্ব ও সার্বিক পরিপূর্ণতার ব্যাপারে এবং তাঁর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জন্য রিসালাত ও সত্যবাদিতার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় দলিল ও সর্বমহান সাক্ষী।

আমার এই লেখার উদ্দেশ্য হল, এই মহান দ্বীনের সৌন্দর্যের নীতিমালার বিবরণ সম্পর্কে আমার যেটুকু জ্ঞান অর্জিত হয়েছে, তা প্রকাশ করা। যদিও এই দ্বীন তার মহত্ব, সৌন্দর্য ও পরিপূর্ণতার যেসব দিককে অন্তর্ভুক্ত করে, তার সামান্যতম অংশ প্রকাশ করার জন্য প্রয়োজনীয় আমার জ্ঞান ও জানা-শোনা খুবই সীমিত এবং তার সৌন্দর্যগুলো বিস্তৃত ব্যাখ্যা দূরে থাক, সংক্ষিপ্ত বর্ণনা করার মতো যোগ্যতায় আমি অতি দুর্বল; তবুও, কোন মানুষ তার সবটুকু না জানলে এবং তার চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছাতে না পরলে তার এই অংশবিশেষ না জানার অক্ষমতা ও দুর্বলতার কারণে সে যতটুকু জানে, ততটুকু প্রকাশ করা থেকে থেকে বিরত থাকাটা তার জন্য উচিত হবে না। কারণ, আল্লাহ তা‘আলা কোন ব্যক্তির উপর তার সাধ্যাতীত কোন কষ্টদায়ক দায়িত্ব অর্পণ করেন না:   অর্থাৎ- “তোমরা যথাসাধ্য আল্লাহর তাকওয়া

[﴿فَٱتَّقُواْ ٱللَّهَ مَا ٱسۡتَطَعۡتُمۡ﴾ [التغابن: 16

অবলম্বন কর।” [সূরা আত-তাগাবুন, আয়াত: ১৬]

আর এই জ্ঞান অর্জন করার মধ্যে বহু রকমের উপকারিতা রয়েছেযেমন:

·        এই শ্রেষ্ঠ ও মহৎ বিষয়ে আত্মনিয়োগ করাটা অন্যতম শ্রেষ্ঠ উত্তম আমলের অন্তর্ভুক্তই বিষয় সম্পর্কে জানা, গবেষণা করা, চিন্তা-ভাবনা করা এবং সেই সম্পর্কে জানা ও বুঝার জন্য প্রত্যেকটি পন্থা অবলম্বন বান্দার সার্বিক ব্যস্ততা ও কর্মকাণ্ডের মধ্যে সর্বোত্তম; আর আপনি এই কাজে যে সময় ব্যয় করবেন, তা একান্ত আপনার কল্যাণের জন্য‌ই, আপনার অকল্যাণের জন্য নয়।

·        নিয়ামতরাজি সম্পর্কে জানা ও তার সম্পর্কে আলোচনা করতে আল্লাহ তা‘আলা ও তাঁর রাসূল নির্দেশ দিয়েছেন; আর তা বড় ধরনের সৎকর্মের অন্তর্ভুক্ত। আর সন্দেহ নেই যে, এই বিষয়টি নিয়ে গবেষণা করা মানেই আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা কর্তৃক তাঁর বান্দাদেরকে প্রদত্ত নিয়ামতরাজির শ্রেষ্ঠ নিয়ামতের ব্যাপারে স্বীকৃতি দেয়া এবং আলোচনা ও চিন্তা-ভাবনা করা এই নিয়ামত হচ্ছে: ইসলামী দ্বীন, যা ব্যতীত আল্লাহ তা‘আলা কোন ব্যক্তির পক্ষ থেকে অন্য কোন দ্বীনকে গ্রহণ করবেন না। ফলে এই আলোচনাটি হবে আল্লাহর কৃতজ্ঞতা প্রকাশের জন্য এবং এই নিয়ামত বৃদ্ধির আবেদনস্বরূপ।

·        নিঃসন্দেহে ঈমান ও তার পরিপূর্ণতার ব্যাপারে মানুষের পরস্পর অনেক বড় ব্যবধানে রয়েছে। আর যখনই কেউ এই দ্বীন সম্পর্কে বেশি জানতে পারবে, তাকে বেশি সম্মান করবে এবং তার প্রতি অধিক খুশি ও আনন্দিত থাকবে, তখনই তা তার ঈমানকে পরিপূর্ণ করবে এবং আস্থা ও বিশ্বাসকে অধিক হারে বিশুদ্ধ করবে। কারণ, এই বিষয়টি ঈমানের সকল মূলনীতি ও নিয়ম-কানুনের স্পষ্ট প্রমাণ

·        দ্বীন ইসলামের দিকে সবচেয়ে বড় দাওয়াত (আহ্বান) হল তার (ইসলামের) যাবতীয় সৌন্দর্য ব্যাখ্যা করা, যে সৌন্দর্যগুলো প্রত্যেক সুস্থ জ্ঞান ও বিবেকসম্পন্ন ব্যক্তিই সাদরে গ্রহণ করে

সুতরাং যদি এই দ্বীনের দিকে আহ্বান করার জন্য এমন কোন ব্যক্তিবর্গ উদ্যোগ গ্রহণ করে যারা এর হাকিকত ও তাৎপর্য ব্যাখ্যা করতে পারে এবং সৃষ্টির নিকট এর কল্যাণকর দিকগুলো বর্ণনা করতে পারে, তবে তা-ই সবাইকে এই দ্বীনের দিকে আকৃষ্ট করার ক্ষেত্রে যথেষ্ট হবে; কেননা, তখন তারা এ দ্বীনকে ধর্মীয় ও পার্থিব স্বার্থের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ বলে প্রত্যক্ষ করবে এবং এর বাহ্যিক ও অভ্যন্তরীণ উপযুক্ততা লক্ষ্য করবে এক্ষেত্রে বিরোধীদের সন্দেহ দূর করা ও তাদের ধর্মের সমালোচনার উদ্যোগ গ্রহণের প্রয়োজন হবে না কেননা, তখন এই দ্বীন নিজেই এর সাথে বিরোধপূর্ণ সকল সন্দেহ দূর করে দেবে; কারণ, এটিই সুস্পষ্ট বর্ণনা ও মজবুত বিশ্বাসে পরিণত করার মত দলিল-প্রমাণাদির দ্বারা ব্যাখ্যাত প্রকৃত সত্য।

তাই এই দ্বীনের আসল চিত্রের অংশবিশেষ ফুটিয়ে তোলাই তা গ্রহণ করা ও অন্যের উপর একে শ্রেষ্ঠ করার ক্ষেত্রে সর্ববৃহৎ ভূমিকা রাখবে।

আর জেনে রাখুন, ইসলামী জীবনব্যবস্থার সৌন্দর্য ব্যাপকভাবে তার সকল মাসআলা, দলিল-প্রমাণ এবং নীতিমালা ও শাখা-প্রশাখায় প্রমাণিতএছাড়াও শরীয়তের বিধিবিধান সংক্রান্ত জ্ঞান ও আহকামে এবং সৃষ্টিজাগতিক ও সামাজিক জ্ঞান-বিজ্ঞানের ক্ষেত্রেও তা প্রমাণিতএখানে এগুলো সম্পূর্ণ অধ্যয়ন ও পর্যবেক্ষণ উদ্দেশ্য নয়; কারণ, তা অনেক ব্যাপক আলোচনার দাবি করে বরং এখানে উদ্দেশ্য হল, এই দ্বীনের এমন কিছু উপকারী বিষয় ও দৃষ্টান্ত উপস্থাপন করা, যার দ্বারা দ্বীনের অন্যান্য সৌন্দর্যের প্রমাণ পাওয়া যায় এবং এতে প্রবেশ করতে ইচ্ছুক প্রত্যেকের জন্য নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হয়। এই দৃষ্টান্তগুলো মূলনীতিমালা ও শাখা-প্রশাখায় এবং ইবাদত ও পারস্পরিক লেনদেন— সর্বত্র বিস্তৃত।

তাই আমরা বলতে চাই আল্লাহ তা‘আলার নিকট সাহায্যপ্রার্থী হয়ে, তাঁর নিকট এই প্রত্যাশায় যে, তিনি আমাদেরকে সঠিক পথ প্রদর্শন করবেন, আমাদেরকে শিক্ষা দেবেন এবং আমাদের জন্য খুলে দেবেন তাঁর দান ও অনুগ্রহের ভাণ্ডার, যার দ্বারা আমাদের অবস্থার উন্নতি হবে এবং আমাদের কথা ও কাজগুলো সঠিক হবে:


প্রথম দৃষ্টান্ত

দ্বীন ইসলাম ঈমানের সেই মূলনীতির উপর প্রতিষ্ঠিত, যেগুলোর উল্লেখ করা হয়েছে আল্লাহ তা‘আলার বাণীতে:

﴿قُولُوٓاْ ءَامَنَّا بِٱللَّهِ وَمَآ أُنزِلَ إِلَيۡنَا وَمَآ أُنزِلَ إِلَىٰٓ إِبۡرَٰهِۧمَ وَإِسۡمَٰعِيلَ وَإِسۡحَٰقَ وَيَعۡقُوبَ وَٱلۡأَسۡبَاطِ وَمَآ أُوتِيَ مُوسَىٰ وَعِيسَىٰ وَمَآ أُوتِيَ ٱلنَّبِيُّونَ مِن رَّبِّهِمۡ لَا نُفَرِّقُ بَيۡنَ أَحَدٖ مِّنۡهُمۡ وَنَحۡنُ لَهُۥ مُسۡلِمُونَ ١٣٦ [سورة البقرة: 136]

“তোমরা বল, ‘আমরা ঈমান এনেছি আল্লাহর প্রতি এবং যা আমাদের প্রতি নাযিল হয়েছে এবং যা ইব্রাহীম, ইস্‌মা‘ঈল, ইসহাক, ইয়া‘কূব ও তার বংশধরদের প্রতি নাযিল হয়েছে, এবং যা মূসা, ‘ঈসা ও অন্যান্য নবীগণকে তাদের রব-এর নিকট হতে দেয়া হয়েছে। আমরা তাদের মধ্যে কোন তারতম্য করি না আর আমরা তাঁরই কাছে আত্মসমর্পণকারী’” [সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ১৩৬]

আল্লাহ তা‘আলা কর্তৃক তাঁর বান্দাদেরকে আদিষ্ট এই মহান নীতিমালা এমন, যার উপর সকল নবী ও রাসূল ঐকমত্য পোষণ করেছেন। আর তা সর্বোত্তম সৎকর্ম ও বিশ্বাসসমূহকে অন্তর্ভুক্ত করে যথা: আল্লাহ তা‘আলা তাঁর রাসূলগণের ভাষায় নিজেকে যে গুণে গুণান্বিত করেছেন সেগুলোর প্রতি ঈমান আনা এবং তাঁর পছন্দসই পথে পরিচালিত হওয়ার সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালানো।

সুতরাং এটি এমন এক দ্বীন, যার মূল বিষয় হল আল্লাহর প্রতি ঈমান; আর যার ফলাফল হল এমন প্রত্যেক কাজে-কর্মে ধাবিত হওয়া, যা তিনি (আল্লাহ) ভালবাসেন এবং পছন্দ করেন; আর তা একনিষ্ঠভাবে আল্লাহর জন্য সম্পাদন করা— এর চেয়ে সুন্দর, মহান ও উত্তম কোন দ্বীন বা জীবনব্যবস্থার কল্পনা করা যায় কি?

আর এটি এমন এক দ্বীন, যার নির্দেশ হচ্ছে নবীগণকে প্রদত্ত সকল কিছুর প্রতি ঈমান আনা; তাঁদের রিসালাতকে বিশ্বাস করা; তাঁরা তাঁদের রব ও প্রতিপালকের পক্ষ থেকে যে সত্য নিয়ে এসেছেন তার স্বীকৃতি প্রদান করা এবং তাঁদের মধ্যে কোন প্রকার পার্থক্য সৃষ্টি না করা; আর এ স্বীকৃতি দেওয়া যে, তাঁরা সকলেই আল্লাহর সত্যবাদী রাসূল ও তাঁর একনিষ্ঠ বিশ্বস্ত বান্দা— সেই দ্বীনের প্রতি কোন প্রকার আপত্তি ও দুর্নাম রটনা করা অসম্ভব।

এই দ্বীন সকল হকের নির্দেশ দেয় এবং সকল প্রকার সত্যের স্বীকৃতি প্রদান করে; আল্লাহ কর্তৃক রাসূলদেরকে প্রদত্ত ওহীর উপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠা দ্বীনি বাস্তবতা সাব্যস্ত করে এবং স্বভাবগত, উপকারী ও যৌক্তিক বৈজ্ঞানিক বাস্তবতাকে সাথে নিয়ে চলে। আর তা কোন কারণেই কোন হক ও সত্যকে প্রত্যাখ্যান করে না এবং কোন মিথ্যাকে সত্যে পরিণত করে না আর তাতে কোন বাতিলের প্রচলন সফল হয় না সুতরাং এই দ্বীন অপরাপর সকল ধর্মের উপর তদারককারী ও তত্ত্বাবধায়ক।

এই দ্বীন সুন্দর আমল (কর্ম), উত্তম চরিত্র ও জনকল্যাণের নির্দেশ দেয় এবং ন্যায়পরায়ণতা, সম্মান, সম্প্রীতি ও কল্যাণের প্রতি উৎসাহিত করে; আর তা সাবধান করে সকল প্রকার যুলুম-নির্যাতন, সীমালংঘন ও দুশ্চরিত্র থেকে। যে পরিপূর্ণ বৈশিষ্ট্যকেই নবী ও রাসূলগণ স্বীকৃতি দিয়েছেন, এই দ্বীন সেই বৈশিষ্ট্যকেই স্বীকৃতি দিয়েছে এবং তাকে প্রতিষ্ঠিত করেছে। যে ধর্মীয় ও পার্থিব কল্যাণের দিকেই কোন বিধান বা শরীআত আহ্বান করেছে, এই দ্বীন তার প্রতিই উৎসাহিত করেছে; আর প্রতিটি অকল্যাণকর বিষয় থেকেই নিষেধ করেছে ও দূরত্ব বজায় রেখে চলতে নির্দেশ দিয়েছে

০ মোটকথা: এই দ্বীনের আকিদা-বিশ্বাসসমূহ এমনই যে, তা দ্বারা অন্তর পবিত্র হয় ও আত্মা পরিশুদ্ধ হয় এবং তার দ্বারা উত্তম চরিত্র ও সৎকর্মের সৌন্দর্য দৃঢ়মূল হয়।

মন্তব্যসমূহ